কোনো মুসলমান মারা গেলে তার জানাজার নামাজের পর (লাশ দাফনের পূর্বে) দোয়া মোনাজাত করা যাবে কি যাবে না এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার চাঁদপুর সদর উপজেলার ৫নং রামপুর ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেঙ্ েদুই পক্ষের আলেমদের মধ্যে বাহাস-মোনাজারা (ধর্মীয় বিতর্ক) অনুষ্ঠিত হয়। এই বাহাসে দোয়া করার পক্ষের সকল আলেম সময়মতো উপস্থিত হলেও দোয়ার বিরোধী পক্ষীয় উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো আলেম আসেননি। তারপরও দোয়ার বিরোধী পক্ষীয় স্থানীয় দু’জন আলেম বাহাসে অংশ নেন। উভয় পক্ষের আলেমদের বাহাস শেষে জানাজার নামাজের পর (লাশ দাফনের পূর্বে) দোয়া করা জায়েয তথা বৈধ এবং সাওয়াবের কাজ বলে রায় ঘোষণা হয়। এ রায় উভয় পক্ষের স্বাক্ষরে লিখিতভাবেই হয়।
জানা গেছে, রামপুর ইউনিয়নে বহু আগ থেকে জানাজার নামাজের পর সম্মিলিতভাবে দোয়া করার বিষয়টি প্রচলন হয়ে আসছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায়ও দোয়া করার বিধানটি প্রচলন আছে। আবার না করার দৃষ্টান্তও আছে। কিন্তু দোয়া যে করতেই হবে বাধ্যতামূলক, এ ধরনের কথা পক্ষীয় লোকদের থেকে কখনো বলা হয়নি। সম্প্রতি রামপুর ইউনিয়নে এক মৃত ব্যক্তির জানাজার পর পর প্রচলিত ধারা অনুযায়ী ইমাম সাহেবসহ সকল মুসলি্ল মোনাজাত করেন। মোনাজাত শেষে এ নিয়ে দু’একজন বিতর্ক করেন। তারা এ ধরনের মোনাজাত করার কোনো বৈধতা নেই বলে দাবি করেন। এতে তখন কিছুটা বিশঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরে আরো কয়েকটি জানাজার নামাজে এমন বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটে। দোয়ায় বাধা সৃষ্টি করে ওই দু’একজন লোকই।
পরে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আল-মামুন পাটওয়ারীর উদ্যোগে উভয় পক্ষের আলেম নিয়ে বসে এর সুষ্ঠু সমাধানের ব্যবস্থা করা হয়। মোনাজাত দেয়ার পক্ষে সর্বোচ্চ পাঁচজন আলেম আনার দায়িত্ব নেন রামপুর আদর্শ আলিম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ আবু জাফর মোঃ মাঈনুদ্দিন আর মোনাজাত না দেয়ার পক্ষে পাঁচজন আলেম আনার দায়িত্ব নেন রামপুর মাদ্রাসার শিক্ষক মাওঃ সিফাত উল্লাহ ও স্থানীয় মাওঃ হারুনুর রশিদ। এ দু’জনই মূলত জানাজার নামাজের পর দোয়া করার ব্যাপারে বাধা দেয়ার মূল হোতা। অধ্যক্ষ আবু জাফর পক্ষীয় পাঁচজন আলেমের নাম যথাসময়ে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিলেও প্রতিপক্ষ নানা টালবাহানা শুরু করে। তারা এক পর্যায়ে চেয়ারম্যানকে জানায় তাদের পক্ষে ফুলছোঁয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মুফতি আবু সাঈদ উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু তারা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়ে তাদের পক্ষীয় কোনো আলেমের নামের তালিকা জমা দেননি।
গতকাল মঙ্গলবার পূর্ব নির্ধারিত সময় বেলা ১২টায় মোনাজাত দেয়ার পক্ষীয় আলেম তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশিষ্ট মোনাজের মুফতি আব্দুর রব আল-কাদেরী, মুফতি শাহ আলম, মুফতি রুহুল আমিন মানছুরী, মুফতি ড. বাকি বিল্লাহ মিশকাত ও মুফতি মাওঃ মোহাম্মদ আলী নকশবন্দী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু বিরোধী পক্ষীয় আলেম মুফতি আবু সাঈদসহ অন্য যারা আসার কথা ছিলো তাদের কেউ আসেনি। তখন মাওঃ সিফাত উল্লাহ ও মাওঃ হারুনুর রশিদই জানাজার পরে দোয়া করা জায়েয নেই -এর পক্ষে আলেম হিসেবে স্বাক্ষর করেন। এ বাহাস অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন রামপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ড. একেএম মাহবুবুর রহমান, নওগাঁও মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ জাকারিয়া চৌধুরী, রামপুর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ আবু জাফর মোঃ মাঈনুদ্দিন, বিষ্ণুদী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ মোঃ জসিম উদ্দিন, ছোটসুন্দর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওঃ আবুল ফারাহ, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ মোস্তফা কামাল কালাম পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক মজিবুর রহমান কাঞ্চন পাটওয়ারী, রামপুর ইউনিয়ন কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি রফিকুল ইসলাম পাটওয়ারী, হাজী মিজানুর রহমান পাটওয়ারী প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
রামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আল-মামুন পাটওয়ারীর সভাপতিত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু হয়। মোনাজাত দেয়ার পক্ষীয় আলেমগণ এক এক করে কোরআনের আয়াত, হাদিস ও বিভিন্ন প্রসিদ্ধ এবং নির্ভরযোগ্য ফিক্হ গ্রন্থের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে জানাজার নামাজের পর দোয়া করা যে বৈধ তা প্রমাণ করতে থাকেন। পক্ষান্তরে বিরোধী পক্ষীয়রা কোনো একটি দলিলও উপস্থাপন করতে পারেননি। মাওঃ হারুন একটি হাদিসের উদ্ধৃতি উপস্থাপন করলেও তার সঠিক ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেন নি, বরং তিনি ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পরে সর্বসম্মতভাবে ফয়সালা হয় যে, ‘জানাজার নামাজের পরে দাফনের পূর্বে একা বা সম্মিলিতভাবে দোয়া করা মুস্তাহাব। যদি এ বিষয়ে আমল করা হয় তাতে গুনাহ নেই বরং সওয়াব আছে। তবে এ আমলকে ওয়াজিব বা বাধ্যবাধকতা মনে করা উচিত নয়। আবার এ আমল কোথাও প্রচলন থাকলে সেখানে নিষেধ করা যাবে না। যোগ্য আলেম, মুফতি ব্যতীত অন্য কেউ এ আমলকে জায়েয বা নাজায়েয মন্তব্য করা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষেধ।’ লিখিত এ ফয়সালার মধ্যে উভয় পক্ষের আলেম, উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং রামপুর ইউপির বর্তমান ও সাবেক চেয়ারম্যানদ্বয়ের স্বাক্ষর রয়েছে।